তাজ্জব লাগে—একজন সিনিয়র শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ভিড় বেশি হয়! যেমন সিনিয়র ডাক্তারের ভিজিট ফি বেশি, কিংবা সিনিয়র অ্যাডভোকেটের পারিশ্রমিক বেশি, কিন্তু শিক্ষকতার মর্যাদা সেই অনুপাতে কখনো বাড়ে না।
নিজেদের টিকিয়ে রাখা এবং মেধা প্রমাণের লড়াইয়ে ক্লান্ত এই মানুষ গড়ার কারিগরদের অভিজ্ঞতা আজ অত্যন্ত গ্লানিকর। ছাত্ররা দাবি আদায়ে রাস্তায় নামে, আন্দোলন করে, কিন্তু শিক্ষকরা সব সহ্য করেন নীরবে—সংযম আর আশার মিশেলে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসর সুবিধা হিসেবে চাকরিকালে মূল বেতনের ৬% টাকা কেটে রাখা হয়, আর কল্যাণ তহবিলের জন্য আরও ৪%। অথচ, নিজের জমানো টাকাই ফিরে পেতে হয় বছর বছর অপেক্ষা করে! প্রায় ৮৮ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী গত চার বছর ধরে এই টাকার জন্য অপেক্ষায় আছেন। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে আবেদনকারীর সারি—আর বাড়ছে অসহায় দীর্ঘশ্বাস।
সংকট দূর করতে এখন প্রয়োজন ৯ হাজার কোটি টাকা, অথচ সরকার দিয়েছে মাত্র ২,২০০ কোটি। ফলে চিকিৎসা, দৈনন্দিন ব্যয়, পারিবারিক দায়িত্ব—কোনোটিই ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না প্রবীণ শিক্ষকরা। আগে অসুস্থ ব্যক্তি, হজযাত্রী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো, এখন সেটিও বন্ধ। বাজেট সংকটের অজুহাতে অধিকার বঞ্চিত করা সত্যিই অমানবিক। এই অবহেলা নতুন প্রজন্মের তরুণদের শিক্ষকতা পেশা থেকে বিমুখ করছে।
একজন প্রবীণ শিক্ষক যখন বেসরকারি স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসার (এমপিও বা নন-এমপিও) সদস্য হয়ে অবসরে যান, তখন পাশে থাকেন না স্বজন বা সহকর্মীও। সমাজের চোখে তিনি হয়ে পড়েন অবহেলার প্রতীক। আয় বন্ধ হলেও ব্যয় থেমে থাকে না—বরং বয়সের ভারে শারীরিক সামর্থ্য কমে গিয়ে জীবন হয়ে পড়ে আরো কঠিন।
সরকার দেশের মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। শিক্ষকবান্ধব সরকার হিসেবে উৎসব ভাতা বাড়ানো, বাড়িভাড়া নির্ধারণের কাজ চলছে—এগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু কিছু অপশক্তি ভুল ব্যাখ্যা ছড়াচ্ছে—যে শিক্ষা জাতীয়করণ নাকি সম্ভব নয়। অথচ বাস্তবে, সরকার যদি এতগুলো সংস্কার ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে শিক্ষা জাতীয়করণও সম্ভব—এবং এখনই তার সময়।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ১৯৬৬ সালের প্যারিস সম্মেলন এবং ১৯৯৪ সালের ইউনেস্কো অধিবেশনে শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষায় যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, বাংলাদেশও তাতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
অবহেলিত শিক্ষকরা গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত প্রজন্ম গড়েছেন আলো দিয়ে, অথচ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তারা অবসর সুবিধার অনিশ্চয়তায় দিন কাটান কষ্টে। তাই এখন সময় এসেছে শিক্ষা জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য এখন শিক্ষাখাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পান বেশি বেতন, আর বেসরকারিরা পান কম—যদিও ছাত্রদের ফি উল্টো অনুপাতেই নেওয়া হয়।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের লড়াইয়ে জাতীয় ঐকমত্য ইতিমধ্যেই রয়েছে। আমলা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ—সবাই নীতিগতভাবে সমর্থন করছেন শিক্ষা জাতীয়করণকে।
অতএব, মানুষ গড়ার কারিগরদের ভবিষ্যৎ রক্ষা ও শিক্ষায় সমতা আনতে এখনই দরকার এক ঘোষণায় শিক্ষা জাতীয়করণ।
‘শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো’র অজুহাত না দেখিয়ে, যা আছে তা বজায় রেখে ধীরে ধীরে মানোন্নয়ন ও ভিত্তি সুদৃঢ় করাই জরুরি। কারণ, ঢেলে সাজানোর নামে অনেক সময় শুধু ঢালা হয়, সাজানো হয় না।
প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ’s)
এমপিওভুক্ত শিক্ষক কারা?
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা হলেন তারা, যাদের বেতন ও ভাতা সরকার Monthly Pay Order (MPO) এর মাধ্যমে প্রদান করে।
অবসর পর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রধান সমস্যা কী?
অবসরকালীন সময়ে আর্থিক অসুবিধা, চিকিৎসা খরচ ও দৈনন্দিন জীবনের ব্যয় মোকাবেলায় শিক্ষকরা ভুগছেন।
অবসর সুবিধার জন্য কত টাকা কেটে রাখা হয়?
চাকরিতে থাকাকালীন সময়ে মূল বেতনের ৬% অবসর তহবিল এবং ৪% কল্যাণ তহবিল হিসেবে কেটে রাখা হয়।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সুবিধা পেতে কেন এতদিন অপেক্ষা করছেন?
সরকারি বাজেট ঘাটতি এবং তহবিল সংকটের কারণে প্রায় ৮৮,০০০ শিক্ষক-কর্মচারী বছর পর বছর অপেক্ষা করছেন।
সরকার কি কোনো সহায়তা দিচ্ছে?
সম্প্রতি সরকার দিয়েছে ২,২০০ কোটি টাকা, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম; ফলে অনেক শিক্ষক চিকিৎসা ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পাশে কে থাকে?
অপ্রয়োজনে স্বজন এবং সহকর্মীরাও অনেক সময় পাশে থাকেন না; সামাজিক অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের কারণে তারা নিঃসঙ্গ বোধ করেন।
শিক্ষা জাতীয়করণ কী এবং কেন জরুরি?
শিক্ষা জাতীয়করণ মানে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা। এতে বেতন ও সুবিধায় সমতা আসে এবং শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
অবসরের পর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবনে দুঃসহ বাস্তবতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সংকট। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও অবসর ও কল্যাণ সুবিধা না পাওয়া, বেতন বৈষম্য, আর সামাজিক অবহেলা—সব মিলিয়ে শিক্ষকদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।