টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্য-৪-এ বলা হয়েছে—সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তবে শিক্ষাবিদদের মতে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এসব লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
বিনামূল্যে শিক্ষার সীমাবদ্ধতা
- বর্তমানে বিনামূল্যে শিক্ষা মূলত প্রাথমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ।
- মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৩% শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে, যেখানে ভর্তি ফি, বেতন ও পরীক্ষার ফি দিতে হয়।
- এ কারণে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি।
শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য
বাংলাদেশে অন্তত ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু আছে—সরকারি বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, এনজিও স্কুল, কওমি, ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি। প্রতিটির কারিকুলাম ও ব্যয় ভিন্ন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।
- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৩% শিক্ষার্থী পড়ছে এবং বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হয়।
- বিপরীতে কিন্ডারগার্টেনে পড়ছে ২৫% শিক্ষার্থী, যেখানে খরচ তুলনামূলক বেশি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সংকট
- মাধ্যমিক স্তরের ৯৩.৭% প্রতিষ্ঠান বেসরকারি।
- ঝরে পড়ার হার: সাধারণ শিক্ষা ৩৫%, মাদ্রাসা ৪০%, কারিগরি শিক্ষা ২৭%।
- উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি কলেজ মাত্র ১১৭টি, বাকি ২,৭৬৩টি বেসরকারি।
- দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেয়া হলেও উচ্চ মাধ্যমিকে তা বন্ধ হয়ে যায়।
শিক্ষাবিদদের মতামত
- ড. মো. আব্দুস সালাম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়): বিভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা ও কার্যকর পরিকল্পনার অভাব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
- রাশেদা কে চৌধুরী (গণস্বাক্ষরতা অভিযান): প্রাথমিক পর্যায় থেকে ধনী-গরিব বৈষম্য দূর করতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা ও সরকারিভাবে একই কারিকুলাম বাস্তবায়ন জরুরি।
সমাধান হিসেবে প্রস্তাব
- অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করা।
- শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কার্যকর মনিটরিং চালু করা।
- সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত কিছু অভিন্ন বিষয় বাধ্যতামূলক করা।
- দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বাড়ানো (কমপক্ষে ৫০০ টাকা)।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
এসডিজি অগ্রগতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ১১৪তম স্থানে, যা আগের বছর থেকে ৭ ধাপ পিছিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরগতি কাটিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা চলবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ’s)
এসডিজি লক্ষ্য-৪ কী নিয়ে কথা বলে?
এসডিজি লক্ষ্য-৪ হলো সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা সুযোগ সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশে বর্তমানে কোন স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়?
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা মূলত প্রাথমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ। মাধ্যমিক স্তরে আংশিক সহায়তা থাকলেও পূর্ণ অবৈতনিক নয়।
মাধ্যমিক স্তরে কত শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে?
প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে, যেখানে বিভিন্ন ফি দিতে হয়।
বিনামূল্যে মাধ্যমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রধান বাধা কী?
প্রধান বাধা হলো ভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আধিক্য, শিক্ষা ব্যয়ের বৈষম্য ও সরকারি বরাদ্দের ঘাটতি।
বাংলাদেশ কি ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য-৪ অর্জন করতে পারবে?
শিক্ষাবিদরা মনে করেন এটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক নীতি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলে সম্ভাবনা আছে।
প্রাথমিক স্তরে কত ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু আছে?
দেশে অন্তত ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে—সরকারি, বেসরকারি, মাদ্রাসা, কওমি, ইংরেজি মাধ্যম ও এনজিও স্কুলসহ।
মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার কত?
সাধারণ শিক্ষায় ৩৫%, মাদ্রাসায় ৪০% এবং কারিগরিতে প্রায় ২৮% শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
উপসংহার
বাংলাদেশ এসডিজি লক্ষ্য-৪ অর্জনের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও বিনামূল্যে মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা থাকলেও মাধ্যমিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আধিক্য, ভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা, আর্থিক বৈষম্য ও ঝরে পড়ার হার এ লক্ষ্য পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, একক কারিকুলাম, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ ও শক্তিশালী মনিটরিং ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এসডিজি লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
