ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন মন্তব্য করেছেন যে, ন্যায্য বেতন ছাড়া শিক্ষকরা কখনও প্রকৃত অর্থে জাতি গঠনের কারিগরে পরিণত হতে পারবেন না।
তিনি বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে চীনের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে বিস্তারিত মতামত তুলে ধরেন।
চীনের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন কাঠামো
সম্প্রতি চীনের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। জানা যায়—
- সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রফেসরের বার্ষিক আয় প্রায় ৪.২ থেকে ২০ লাখ টাকা।
- বেইজিং বা সাংহাইয়ের মতো শহরের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই আয় দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত।
- কর, সামাজিক নিরাপত্তা ও আবাসন তহবিল কেটে নেওয়ার পরও হাতে থাকে প্রায় ১২.৮ থেকে ২০ লাখ টাকা।
- এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভাতা, আবাসন সুবিধা, গবেষণা তহবিল ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে বোনাস।
এই প্রতিযোগিতামূলক বেতন কাঠামো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও পাল্লা দিতে সক্ষম, বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসায় শিক্ষায়।
চীনের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের অবস্থান
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, চীন সমান গুরুত্ব দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষায়ও।
- একজন প্রাথমিক শিক্ষক মাসে গড়ে ৪ লাখ টাকা আয় করেন।
- কর্মজীবনের শুরুতে আয় থাকে প্রায় ২ লাখ টাকা, আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা বেড়ে ৫ লাখ বা তারও বেশি হয়।
- সরকারি স্কুলে স্থিতিশীল বেতন কাঠামোর পাশাপাশি বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক স্কুলে এই আয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত হতে পারে।
- আবাসন ভাতা, স্বাস্থ্যবীমা ও বোনাস পেশাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
চীনের সরকার শিক্ষা খাতকে ব্যয় নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নের কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে। ফলে শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক প্রণোদনা ও উন্নত কর্মপরিবেশ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
চীনের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশও অনেক কিছু শিখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—
- সব স্তরের শিক্ষক বেতন ধাপে ধাপে বাড়ানো জরুরি।
- আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।
- ক্যারিয়ার ধাপ ও কর্মদক্ষতার স্বচ্ছ মূল্যায়ন চালু করা উচিত।
- আধুনিক শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
- শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়ন অগ্রাধিকারের (প্রযুক্তি, কৃষি, সবুজ শিল্প) সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
যদি বাংলাদেশ জিডিপির কমপক্ষে ৬% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করে, শিক্ষকতার মর্যাদা বাড়ায় এবং ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করে, তাহলে একটি দক্ষ ও ভবিষ্যতমুখী কর্মশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব।
অধ্যাপক মামুনের প্রশ্ন
অধ্যাপক মামুন শেষ দিকে তীব্র প্রশ্ন তুলেছেন—
- “আপনি কি প্রাথমিক শিক্ষকদের ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে বিশ্বের যোগ্য মানুষ তৈরি করতে পারবেন?”
- “আপনি কি একজন প্রভাষককে ৩৫ হাজার টাকা বেতন দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ও গবেষক বানাতে পারবেন?”
তার মতে, ন্যায্য বেতন ছাড়া শিক্ষকরা কখনও জাতি গঠনের প্রকৃত কারিগরে পরিণত হতে পারবেন না। এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ’s)
ন্যায্য বেতন কি শিক্ষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
অধ্যাপক মামুন বলেন, ন্যায্য বেতন শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে জাতি গঠনের প্রকৃত কারিগরে পরিণত করে।
চীনের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কেমন?
চীনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বার্ষিক আয় ৪.২–২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষকের মাসিক বেতন ২–৫ লাখ টাকা বা তার বেশি।
চীনের বেতন ব্যবস্থা বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য কী শিক্ষা দিতে পারে?
চীনের উদাহরণ দেখায়, শিক্ষার ক্ষেত্রে ন্যায্য বেতন, ভাতা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ন্যায্য বেতন শিক্ষকদের জন্য কি প্রেরণা তৈরি করে?
হ্যাঁ, ন্যায্য বেতন শিক্ষকদের মানসিকভাবে উৎসাহিত করে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আরও মনোযোগী ও দক্ষ হতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে শিক্ষক বেতন বাড়ানো কতটা জরুরি?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব স্তরের শিক্ষকের বেতন ধাপে ধাপে বৃদ্ধি এবং আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা নিশ্চিত করা দেশের শিক্ষা খাতকে শক্তিশালী করবে।
ন্যায্য বেতন শিক্ষকদের জাতীয় উন্নয়নে কীভাবে অবদান রাখে?
উচ্চ বেতন এবং সামাজিক মর্যাদা শিক্ষককে আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে তোলে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাকে উন্নত করে এবং কর্মশক্তি গঠনে সহায়তা করে।
প্রাথমিক শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য কি?
চীনের মতো দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন প্রফেসরের পদমর্যাদা এবং শহরের ওপর নির্ভর করে বেশি হয়। প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন স্থিতিশীল হলেও ভাতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
ন্যায্য বেতন শিক্ষকদের শুধু আর্থিক নিরাপত্তা দেয় না, বরং তাদের জাতি গঠনের প্রকৃত কারিগরে পরিণত করে। চীনের উদাহরণ দেখায় যে, প্রতিযোগিতামূলক বেতন, ভাতা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করে এবং ভবিষ্যতের দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি করে। বাংলাদেশও যদি শিক্ষক বেতন বৃদ্ধি, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত এবং আধুনিক শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করে, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থা কেবল একটি চাকরি নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
